আমরা আমাদের জীবনে অনেক মানুষকে দেখেছি যারা অনেক জ্ঞানী হওয়া সত্ত্বেও নিজেদের সঠিকভাবে উপস্থাপন ও প্রকাশ করতে পারেন না। এমনকি শিক্ষা জীবনে এমন অনেক শিক্ষকদের দেখেছি যাঁদের পড়া আমাদের বুঝতে বেশ কষ্ট হয়ে যেত। নিঃসন্দেহে তারা অনেক জ্ঞানী কিন্তু ঘাটতি ছিল তাদের উপস্থাপনের।
সুন্দর করে কথা বলা হচ্ছে একটি আর্ট। স্মার্টনেসের প্রথম শর্ত সুন্দর করে কথা বলার কৌশল জানা। অনেকেই দেখা যায় অনেক জ্ঞানী হওয়া সত্ত্বেও কথা বলার কৌশল না জানায় সঠিকভাবে নিজের মনেরভাব প্রকাশ করতে ব্যর্থ হয়, যার ফলে শ্রোতারা অল্পতেই আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। নিজেকে প্রকাশ করতে কে না চায়? বাহ্যিক সৌন্দর্যের মধ্যে ভাব প্রকাশের সৌন্দর্য হচ্ছে অন্যতম একটি উপাদান। আর এজন্যই প্রয়োজন স্মার্টভাবে ইংরেজি ও বাংলা কথা বলার উপায় জানা।
শুদ্ধ বাংলা ভাষায় কথা বলা কাজটা খুব কঠিন কিছু নয়। মুখের জড়তা দূর করার উপায় জানলে জনসম্মুখে ইংরেজি কিংবা বাংলা কথা বলা কিংবা বক্তব্য রাখাও বেশ সহজ হয়ে যায়। তেমনি ইংরেজিতে কথা বলার জন্য প্রয়োজনীয় শব্দ ও শুদ্ধভাবে ইংরেজি উচ্চারণ করার নিয়ম জানলে গুরুত্বপূর্ণ এই ভাষাটাও সহজ হয়ে যায়। কিভাবে ইংরেজিতে কথা বলব, এটা চিন্তা করে উদ্বিগ্ন না হয়ে নিজের চেষ্টা এবং সামান্য কিছু গাইডলাইন নিয়ে এগিয়ে যাওয়াই যথেষ্ট। বাংলা ও ইংরেজিতে সুন্দর করে কথা বলার কৌশল ও মুখের জড়তা দূর করার উপায় নিয়েই মূলত আজকের এই ব্লগ।
সুন্দর করে কথা বলার কৌশল ১: নিজেকে বিশ্লেষণ কর
প্রথমেই নিজেকে বিশ্লেষণ করতে হবে। তুমি কী বিষয়ে কথা বলছ, কীভাবে কথাটি শুরু করছ, কার সঙ্গে কথা বলছ এবং তার সাথে দেখতে হবে তোমার কণ্ঠস্বরটি কেমন। সেটি কি খুব বেশি কর্কশ , খুব মিষ্টি নাকি স্বাভাবিক। যেই বিষয় নিয়ে তুমি কথা বলছ সেই বিষয়ে তোমার দক্ষতা কেমন এটি জানা ও খুব গুরুত্বপূর্ণ। এসব বিশ্লেষণের ফলাফল কাগজে লিখে রাখাই ভাল। সুন্দর করে ইংরেজি কিংবা বাংলা কথা বলা পুরোটাই চর্চার ওপর নির্ভরশীল।
সুন্দর করে কথা বলার কৌশল ২: আগে শোনার ওপর গুরুত্ব দাও
কোন একটা আলোচনায় যোগ দিতে গেলে আগে শোন কে কী বলছে। হুট করে কোন মন্তব্য করা বোকামির কাজ। মূল বিষয়টি নিয়ে কিছুক্ষণ চিন্তা কর। কেউ যদি অনেক সুন্দর করে উপস্থাপন করে তবে তাকে অনুসরণ করা যেতে পারে। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলার কৌশল।
সুন্দর করে কথা বলার কৌশল ৩: আত্মবিশ্বাস
যা বলবে আত্মবিশ্বাসের সাথে বলবে। দ্বিধা নিয়ে কিছু বলা উচিৎ নয়। বক্তাকে দ্বিধান্বিত দেখলে শ্রোতারা বক্তার ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলে। আর যা বলছো, সেই কথাটি বলার সময় আত্মবিশ্বাসের কারণটি ও বলা যেতে পারে। ইংরেজি তে বক্তব্য দিতে হলে কিভাবে ইংরেজিতে কথা বলব এই বিষয়ে বেশি ভাবা যাবে না।
সুন্দর করে কথা বলার কৌশল ৪: সুস্পষ্ট মতামত প্রয়োগ কর
কখনোই এমন কোন কথা বলা উচিত নয় যেটিতে মানুষ খুব বিব্রতবোধ করে কিংবা বিষয়বস্তুর সঙ্গে একদমই খাপ খায় না। অন্যের কথার মাঝে কথা বলাটা অনেকেই পছন্দ করে না। তবে কথা যদি বলতেই হয় সেটি ভদ্রভাবে বললে সবাই তাতে সাড়া দেবে। যেমন: “Excuse me” বলে বক্তার কথার সাথে কিছু যোগ করা যেতে পারে কিংবা সেই বিষয়ে কোন ব্যক্তিগত মতামতও দেয়া যেতে পারে।
ইংরেজি ও বাংলা কথা বলার কৌশল ৫: পরিবেশ পরিস্থিতির দিকে খেয়াল কর
পরিবেশ পরিস্থিতি সব সময় এক থাকবে না। সেই পরিবেশ পরিস্থিতি বিবেচনা করে কথা বলতে হয়। একটি আলোচনার ক্ষেত্রেও পরিবেশ পরিস্থিতি পরিবর্তন হয়। কখনো হাসির সময় আসে আবার কখনো কঠোর সময় আসে কিংবা অনেক সময় অনেক গম্ভীর পরিস্থিতি তৈরি হয়। সব পরস্থিতিতে সব কথা মানায় না। নির্দিষ্ট সময়পোযোগী মন্তব্য করাই ভাল ।
ইংরেজি ও বাংলা কথা বলার কৌশল ৬: মূল বিষয়ের দিকে লক্ষ্য রাখো
কথা বলার সময়, সবসময় মূল বিষয়ের দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। অনেক সময় কথা বলতে বলতে বক্তা মূল বিষয় থেকে সরে পড়ে। তখন শ্রোতারা খুব বিরক্তবোধ করে। কারণ তারা তাদের মূল্যবান সময় গল্পে নষ্ট করতে চান না। দরকার হলে লিখে রাখতে পারো যেটি নিয়ে কথা বলতে চাও। তাহলে বক্তব্যগুলো মূল বিষয়ের মধ্যেই চলে আসবে।
ইংরেজি ও বাংলা কথা বলার কৌশল ৭: Gap দিয়ে কথা বলো
কথা বলার সময় একটু gap দিয়ে কথা বললে শ্রোতাদের বুঝতে সুবিধা হয়। বেশি তাড়াতাড়ি কথা বলা খুব বাজে একটি অভ্যাস। এতে শ্রোতাদের ও বুঝতে কষ্ট হয়। Gap দিয়ে কথা বললে মূল বিষয়ের ওপর গুরুত্বও দেয়া যায়। অন্যদিকে ধীরগতিতে কথা বললে শ্রোতারা বিরক্তবোধ করে এবং শোনার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। সুতরাং, মধ্যবর্তী একটি মাপ বেছে কথা বললে শ্রোতাদের কাছে গ্রহণযোগ্য হওয়া যায়। কথা বলার সময় গুরুত্ব অনুযায়ী কণ্ঠস্বর পরিবর্তন করা যেতে পারে। এটিও একটি কার্যকরী কথা বলার কৌশল।
শুদ্ধ বাংলা ভাষায় কথা বলার নিয়ম ও করণীয়
শুদ্ধ বাংলা ভাষায় কথা বলার নিয়ম ও করণীয় |
|
চলিত ভাষায় কথা বলো |
একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলার কৌশল হলো যে ভাষা সবাই বুঝে সে ভাষায় কথা বলা। উচ্চারণ শুদ্ধ করলে কথা শুনতেও অনেক ভালো লাগে । সঠিক বাংলা উচ্চারণ করে তাক লাগিয়ে দেয়া যায়। খুব বেশি দরকার পড়লে উচ্চারণের ওপর কিছু কোর্স ও করা যেতে পারে। |
কোনো সোর্স অনুসরণ কর |
উচ্চারণ সুন্দর করতে কিংবা জ্ঞান আহরণে বিভিন্ন সোর্স অনুসরণ করা যেতে পারে। যেমনঃ খবর, সিনেমা, বিতর্ক প্রতিযোগিতা ইত্যাদি। |
বিভিন্ন রকম বই পড় |
জ্ঞান অর্জনে বই এর বিকল্প নেই। উচ্চারণ শুদ্ধ করতে বই এর কঠিন শব্দগুলো জোরে জোরে পড়ে অনুশীলন করা যেতে পারে । |
সুতরাং দেখা যাচ্ছে, সুন্দর করে কথা বলার কৌশল জানলে এটি পুরোটাই নিজের হাতে । নিজস্ব চেষ্টা এবং উপরের গাইডলাইনগুলো অনুসরণ করলে সুন্দর করে কথা বলার কৌশল আসবে নিজের হাতের মুঠোয়।
জনসম্মুখে কথা বলা নিয়ে ভয়?
এইতো আর পাঁচ মিনিট পরেই তোমার পালা। বেশিক্ষণ বাকি নেই মঞ্চে উঠতে, সবার সামনে নিজের বক্তব্য রাখার সময় চলে এসেছে। এটা মনে পড়তেই হুট করে তোমার হৃদস্পন্দন যেন বেড়ে গেলো, হাত-পা কাঁপতে বা ঘামতে শুরু করলো। আমাদের অনেকের মধ্যে জনসম্মুখে কথা বলা নিয়ে ভীতি কাজ করে। বিজ্ঞানের ভাষায় একে বলে ‘গ্লসোফোবিয়া’। এই সমস্যাটি এড়ানোর জন্য আত্মপ্রচেষ্টার কোনো বিকল্প নেই!
বর্তমান যুগে পাব্লিক স্পিকিং-এর গুরুত্ব বলে শেষ করা সম্ভব না। যেকোনো ক্ষেত্রে এই গুণটি তোমাকে হাজার হাজার প্রতিযোগীর মাঝে অনন্য করে তুলবে। যেকোনো আইডিয়া সবার সামনে তুলে ধরতে কিংবা এক সাথে অনেক মানুষকে অনুপ্রাণিত করতে হলে পাব্লিক স্পিকিং -এর দক্ষতা অত্যাবশ্যক। একাডেমিক কাজে প্রেজেন্টেশন দেয়া কিংবা ডিবেট করা, মডেল ইউনাইটেড ন্যাশনস এ অংশ নেয়ার ক্ষেত্রে প্রয়োজন শুদ্ধভাবে ইংরেজি উচ্চারণ করার নিয়ম জানা। কাজটি যতটা কঠিন মনে হয় আসলে ততটা কঠিন নয়। চাইলে তুমিও হয়ে উঠতে পারো একজন “Elocutionist”!
এজন্য তিনটি শব্দ মনে রাখতে হবে: ১।পরিকল্পনা, ২।প্রস্তুতি এবং ৩।চর্চা। চলো দেখে নেই কিভাবে জনসম্মুখে কথা বলার আত্মবিশ্বাস অর্জন করা যায়।
জনসম্মুখে মুখের জড়তা দূর করার উপায় ১: পরিকল্পনা
যেকোনো কাজে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিকটি হলো পরিকল্পনা। সঠিক পরিকল্পনা ছাড়া কোনো কাজেই সফলতা অর্জন করা সম্ভব না। তবে শুধু পরিকল্পনা করে থেমে থাকলেই চলবে না, কাজে নামতে হবে সেই অনুযায়ী। শুরুতে একটি আউটলাইন তৈরি করে নাও বক্তব্যের। অর্থাৎ বক্তব্যের শুরুটা কী দিয়ে করবে, মাঝের মূল বিষয়ে কী কী পয়েন্ট থাকবে এবং শেষে উপসংহার কী দিয়ে টানবে। বক্তব্য যদি ইংরেজিতে হয়, তাহলে শুদ্ধভাবে ইংরেজি উচ্চারণ করার নিয়ম জেনে নাও।
শুরুতে বিষয় সম্পর্কিত যেকোনো মনীষীর উক্তি কিংবা গল্প দিয়ে শুরু করলে দর্শকের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যায়। তাছাড়া গুরুগম্ভীর কথার চেয়ে হাস্যরসপূর্ণ কথা শ্রোতাকে বেশি আকৃষ্ট করে। তাই শুরুতে একটি ছোট্ট কৌতুক দিয়ে শুরু করা যেতে পারে। অবশ্যই তা মূল বক্তব্যের বিষয়বস্তুর সাথে সম্পর্কিত হতে হবে। এরপর তথ্য বহুল কিংবা বিশ্লেষণ নির্ভর আলোচনাগুলোকে সাজিয়ে নাও।
তবে মূল তথ্যগুলো সাজানোর সময়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ এবং কম গুরুত্বপূর্ণ অনুযায়ী বাছাই করতে হবে। এরপর অধিক জরুরি তথ্যগুলোকে বক্তব্যের প্রথম দিকে সাজিয়ে নিতে হবে। অনেক সময়ে দেখা যায় নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বক্তা তার পুরো বক্তব্য শেষ করতে পারেন না, অধিক প্রয়োজনীয় তথ্যগুলো শেষে বলার পরিকল্পনা থাকায়। তাই সময়ের মধ্যে সকল গুরুত্বপূর্ণ তথ্য যাতে তুলে ধরার জন্য সেগুলো প্রথমার্ধে বলার চেষ্টা করতে হবে।
মঞ্চে উঠে আমরা অনেক সময়েই লিখিত বক্তব্যটি ভুলে যাই। এক্ষেত্রে বক্তব্যকে পয়েন্ট আকারে খসড়াভাবে লিখে ফেলতে পারো। পুরো বক্তব্য মনে রাখার চেয়ে পয়েন্ট মনে রাখা বেশি সুবিধাজনক। খসড়া দেখে দেখে বক্তব্য দেয়া একজন বক্তার অন্যতম দুর্বলতা হিসেবে বিবেচিত হয়। তাছাড়া এতে শ্রোতা একঘেয়ে বোধ করে। তাই চেষ্টা করতে হবে যথাসম্ভব না দেখে সাবলীলভাবে কথা বলার অভ্যাস করা।
প্রয়োজনে লিখিত পয়েন্টগুলো সামনে রাখা যেতে পারে। এতে ভুলে যাওয়ার সম্ভাবনা এড়ানো যাবে। তাছাড়া বক্তব্যকে আরো আকর্ষণীয় করে তুলতে দর্শকের জন্য কিছু প্রশ্ন টুকে রাখতে পারো কাগজে। প্রশ্ন করার ফলে দর্শক শুধু একঘেয়েমিভাবে বক্তব্য শুনবে না বরং নিজেরাও চিন্তা করার সুযোগ পাবে। দর্শকের মতামতকে গুরুত্ব দিলে পুরো উপস্থাপনাটি প্রাণবন্ত হয়ে উঠবে।
প্রস্তুতির বিশেষ একটি অংশ হলো গভীরভাবে পড়াশোনা করা। যেই বিষয়ে কথা বলতে হবে, সেই বিষয়টি সম্পর্কে যত গভীরভাবে জানবে ততই তোমার আত্মবিশ্বাস বাড়বে। তাছাড়া শ্রোতার নানান প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় একজন বক্তাকে। সেক্ষেত্রে ঐ বিষয়ে গভীর জ্ঞান সেসকল প্রশ্নের উত্তর সাবলীলভাবে দিতে সহায়তা করবে।