ভূগোল ক্লাস নিয়ে ভাবনা সবসময়ই তটস্থ থাকে। প্রথমত সে মনে রাখতে পারে না কিছুই, দ্বিতীয়ত কোন কিছু জিজ্ঞেস করার জন্য টিচারদের চোখ সবসময় তার উপরেই আগে পড়বে। হঠাৎ করে অন্য সেকশনের ইমতিয়াজ স্যার তাদের ক্লাসে ঢুকলেন। জানা গেল, টুটুল স্যার অসুস্থ, তাই ইমতিয়াজ স্যারই আজকে ক্লাস নিবেন।
স্যার প্রথমেই পুরো ক্লাসকে কয়েকটা গ্রুপ ভাগ করে নিলেন। ছোট ছোট গ্রুপগুলোর মধ্যে আবার সবার কাজ আলাদা। কারো দায়িত্ব পড়লো ভিডিও দেখে নোট নেওয়ার, কেউ কেউ শুধু অডিও শুনবে, ভাবনা ও আরও কয়েকজনের দায়িত্ব পড়লো টুকরো মানচিত্রকে আঠা দিয়ে জোড়া লাগানো। ক্লাসে নীরব হাসির জোয়ার বয়ে গেল। এইসব অর্থহীন কাজ দিয়ে স্যার আসলে কি শিখাতে চাইছেন? তার থেকে বাকি টিচাররা ক্লাসে এসে মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টরে ভিডিও ছেড়ে বসে থাকেন, সেটাই বেশি ইফেক্টিভ!
এই পর্যন্ত ঠিকই ছিল, কিন্তু ক্লাস শেষ হওয়ার পর সবাই একটু অবাক। যেমন- ভাবনার মনে হতে লাগলো মাত্র চল্লিশ মিনিটে সে ইউরোপ মহাদেশ সম্পর্কে মোটামুটি ধারণা পেয়ে গেছে। যারা শুধু ছবি দেখেছে তারাও একমত। লিমার মতে, হাতে কলমে কিছু করার চাইতেও কোন কিছু দেখে দেখে সে তাড়াতাড়ি শিখতে পারে।
ভাবনার কেমন যেন মনে হলো, তাদের সবার লার্নিং প্রসেসটা মনে হয় আলাদা। একেকজন একেকভাবে শিখে। কিন্তু ইমতিয়াজ স্যার কিভাবে পারলেন সবাইকে এত দ্রুত আলাদা ক্যাটাগরি করতে? ক্লাস করার সময় তাদের মনেই হয়নি একজন টিচার ক্লাসে ছিলো, বরং মনে হচ্ছিল নিজেরাই সব শিখছে একা একা। সব টিচাররাই ল্যাপটপ, মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টরের হেল্প নেন, তবে তা শুধু ভিডিও দেখাতে! ইমতিয়াজ স্যার কি ম্যাজিশিয়ান নাকি!
এই রহস্যের খোঁজেই আমাদের আজকের যাত্রা —–
এডুকেশনাল টেকনোলজি অথবা প্রযুক্তির সাথে শিক্ষার সম্পর্ক
ক্লাসরুমে টেকনোলজি ব্যবহারে বাংলাদেশ এখন একদমই পিছিয়ে নেই। বেশ প্রত্যন্ত অঞ্চলেও অনেক স্কুলেই ল্যাপটপ, মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর ব্যবহার করা হয়। প্রশ্ন হচ্ছে টেকনলজির সর্বোচ্চ ব্যবহার আমরা করতে পারছি কি না!
শিক্ষক ক্লাসে পড়াচ্ছেন- এটা একটা নিয়মিত দৃশ্য। এই দৃশ্যে যদি আমরা টেকনোলজিকে ঢোকাতে চাই, তাহলে আগে বর্তমান সিচুয়েশনটা বুঝতে হবে।
আমাদের ট্র্যাডিশনাল ক্লাসরুমগুলো সাধারণত টিচার লেকচার দেওয়ার মাধ্যমে পড়ান। তবে বৈশ্বিক দৃষ্টিকোণ এটি একেবারেই সেকেলে পদ্ধতি। তবে আমাদের দেশে এখনও পর্যন্ত এটাই সবচেয়ে প্রচলিত এবং কম ইফেক্টিভ। অনেক ক্ষেত্রেই এখানে টু-ওয়ে কমিউনিকেশনের বিষয়টা থাকে না।
এর বাইরে ছোট গ্রুপে ভাগ করে টিম ওয়ার্ক, পার্সোনাল টিউশন বা কোচিং বেইজড লেখাপড়াও আছে।
তাহলে এই ধরণের টিচিংকে আমরা এক কথায় ’ফেস টু ফেস টিচিং’ বলে ধরতে পারি। তাহলে গুগল, ইউটিউবের বিভিন্ন চ্যানেল থেকে আমরা যা শিখি, সেটাকে অনলাইন টিচিং বলা যায়।
তাহলে কোন টিচার যদি তার স্টুডেন্টদের দুইভাবেই পড়াতে চান তাহলে কি তিনি ক্লাসে গুগল করে বিভিন্ন তথ্য জানিয়ে, বা ইউটিউবে ক্লাস লেকচারের সাথে রিলেভেন্ট কিছু ভিডিও দেখিয়ে পড়ালে আমরা সেটাকে ইফেক্টিভ হিসেবে ধরতে পারি? কিন্তু এক্ষেত্রে টু-ওয়ে কমিউনিকেশন বা শিক্ষার্থীদের ইন্টার্নাল কোন পরিবর্তন হচ্ছে কি না, সবাই শিখতে পারছে কি না- তা কিভাবে নিশ্চিত হচ্ছে?
এই সমস্যার সমাধানের নামই ‘ব্লেন্ডেড লার্নিং’ সিস্টেম।
ব্লেন্ডেড লার্নিং! সে আবার কী!
নাম শুনেই মনে হচ্ছে কোন কিছু ব্লেন্ড বা মেশানোর ব্যাপারে বলা হচ্ছে। আসলেই তা-ই। ফেস টু ফেস টিচিং আর অনলাইন টিচিং-কে একসাথে মিশিয়েই ব্লেন্ডেড লার্নিং মেথডে লেখাপড়া করানো হয়। ব্লেন্ডেড লার্নিং মূলত ট্র্যাডিশনাল টিচিং মেথডের সাথে ই-লার্নিং-এর সমন্বয়ে একটি হাইব্রিড টিচিং মেথড তৈরি করে।
কিন্তু আমরা ডিজিটাল ক্লাসরুম বলতে যা বুঝি তার সাথে ব্লেন্ডেড লার্নিং-এর পার্থক্য আছে। এই সিস্টেম গতানুগতিক শেখার পদ্ধতির বেসিক টেকনিককে পরির্বতন করেছে। প্রত্যেক মানুষের শেখার স্টাইল আলাদা, কেউ শুনে শেখে, কেউ দেখে শিখে, কেউ হাতে-কলমে না করে শিখতে পারে না, আবার কেউ কেউ দলের মধ্যে বেশ ভালভাবে শিখে। ব্লেন্ডেড লার্নিং মডেল সব ধরণের মানুষকে স্বাধীনভাবে নিজের ইচ্ছেমত লেখাপড়া করাকে সাপোর্ট দেয়। ইতিমধ্যে ‘ফ্লিপড ক্লাসরুম’ নামক স্বতন্ত্র্য অ্যাপ্রোচের ধারণা আমাদের সামনে এসেছে।
ট্র্যাডিশনাল লেখাপড়ায় এক দিনে কী শেখানো হবে, কতটুকু শেখানো হবে- সেটা টিচার ঠিক করেন। ব্লেন্ডেড লার্নিং মডেল স্টুডেন্টের সামর্থ্যকে বেশি গুরুত্ব দেয়। যারা কুইক লার্নার, যারা স্লো লার্নার, যারা একটু বিরতি দিয়ে, নোট নিয়ে পড়াশোনা করতে চায়- তারা সবাই এই মেথডে ওয়েলকাম। ব্লেন্ডেড মডেলে প্রত্যেক স্টুডেন্টের শিখতে যত সময় লাগে, টাইম লিমিট সবার আলাদাও হলেও- প্রত্যেককে পযাপ্ত সময় দেওয়া যায়।
টিচার লেসন প্র্যাকটিসের সময় কোন কিছু নিয়ে চিন্তার গভীরে কিভাবে ঢুকতে হয় তা শেখান। স্টুডেন্টের লার্নিংকে মূল্যায়ন করার জন্য এই মেথড এখনও পর্যন্ত সবচাইতে ইফেক্টিভ। যেহেতু টিচার যা যা শেখান, সেগুলোর পূর্ণাঙ্গ ডকুমেন্টেশন থাকে, তাই কেউ পরবর্তীতে কোন ইন্সট্রাকশন ভুলে গেলেও সমস্যা হয় না।
কিভাবে এলো ব্লেন্ডেড লার্নিং মেথড
ব্লেন্ডেড লার্নিং এর চিন্তাটা শুরু হয়েছে ১৯৬০ সালে। টেকনোলজির সাহায্যে লেখাপড়াকে সহজ করে তোলা ছিল এর উদ্দেশ্য। প্রশিক্ষকের হিসেবে থাকবে মেইনফ্রেম ও মিনি-কম্পিউটার। এরা একাই অনেক শিক্ষার্থীকে শেখাতে পারে। ইউনিভার্সিাট অভ ইলিনয় এবং কন্ট্রোল ডাটা- র উদ্যোগে”প্রোগ্রামড লজিক ফর অটোমেটিক টিচিং” বা প্লাটো স্বয়ংক্রিয়ভাবে শেখাতে পারে এমন একটি প্রোগ্রাম ডেভেলপ করা হলো। ১৯৭০ সালে স্যাটেলাইট-বেজড লাইভ ভিডিও শুরু করা হয়। কিন্তু এটি খুবই ব্যয়বহুল ছিল। এডুকেশনে টেকনোলজির সাহায্য নেওয়ার জন্য এরকম আরও কিছু টুকিটাকি গবেষণা চলতে থাকে।
এরই ধারাবাহিকতায় ব্লেন্ডেড লার্নিং প্রথমবার বাস্তবায়ন হয়েছে ১৯৯০ সাল থেকে। ১৯৯০ সালে প্রথমবার আটলান্টার একটি এডুকেশনাল কোম্পানি, তাদের ইন্টারএ্যাকটিভ লার্নিং সেন্টারের প্রেস রিলিজে প্রথমবার’ইপিআইসি লার্নিং’ নামে এর ঘোষণা দেয়। ’ব্লেন্ডেড লার্নিং’ টার্মটি নিয়ে অস্পষ্টতা ছিল। ২০০৬ সালে গ্রাহাম এবং বঙ্কের ‘হ্যান্ডবুক অভ ব্লেন্ডেড লার্নিং’ পাবলিকেশনে গ্রাহাম বলেন, ‘ব্লেন্ডেড লার্নিং’ এমন একটি সমন্বিত শিক্ষা প্রক্রিয়া যেখানে মুখোমুখি ইন্সট্রাকশন ও কম্পিউটার ব্যবহার করে ইন্সট্রাকশনের ব্লেন্ডেড মডেল। ’ডিফাইনিং ব্লেন্ডেড লার্নিং’ শিরোনামে একটি গবেষণায় নর্ম ফ্রিজেন এর নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।
ব্লেন্ডেড লার্নিং মডেল
‘ব্লেন্ডেড লার্নিং’ মডেলের কিছু গুরুত্বপূর্ণ পার্ট আছে। টিচার ট্র্যাডিশনাল ক্লসের মতই এখানে লেকচার দিবেন, ইন্সট্রাকশন দিবেন। একে বলা হচ্ছে- ফেস টু ফেস ড্রাইভার। তবে গতানুগতিক লেখাপড়ার সাথে এর পার্থক্য হচ্ছে- ক্লাস শুরু হবার আগেই টিচার লেসন প্ল্যান, ম্যাটেরিয়াল, অনলাইন রেফারেন্স, রিলেভেন্ট সফটওয়্যার, অডিও ও ভিডিও ফাইল ইত্যাদি প্রস্তুত করে রাখবেন। অর্থাৎ ক্লাস নেওয়ার জন্য যত ধরণের ভার্চুয়াল হেল্প নেওয়া যায়- টিচারকে সবকিছুই জানতে হবে।
এই মেথডে অলসভাবে বসে বসে ক্লাস করার কোন সুযোগ নেই। ক্লাসে প্রত্যেকের পার্টিসিপেশন থাকে, ঘুরে ঘুরে ক্লাস করতে হয়, বলা হয় বিভিন্ন স্টেশন ঘুরে লেসন প্র্যাকটিস করতে হয়। আবার যে যার মত অনলাইন স্টাডিরও স্বাধীনতা থাকবে। একে ‘রোটেশন’ বলা হয়। ফেস টু ফেস টিচিং এর জন্য ’ল্যাব’ নামক ট্র্যাডিশনাল ক্লাসরুমও থাকবে।
স্টুডেন্টরা নিজেরাও প্রয়োজনীয় অনলাইন কোর্স সিলেক্ট করতে পারে। অনলাইন কোর্স কমপ্লিট করাকেও মার্ক করা হয়, তবে তা কোন একজন টিচারের নিয়ন্ত্রণে থাকবে। মোট কথা যে যেভাবে শিখতে চাইছে, পরীক্ষা দিতে চাইছে, অ্যাসাইনমেন্ট করতে চাইছে- সবকিছুরই সুযোগ এখানে থাকবে।
ডিজিটাল প্লাটফর্মে টিচারের সাথে স্টুডেন্টের যোগাযোগ থাকতে হবে। টিচার চাইলে ক্লাসের আগে বিভিন্ন ধরণের রিডিং ম্যাটেরিয়াল স্টুডেন্টকে শেয়ার করতে পারেন, পরবর্তীতে ক্লাসে তা নিয়ে আলোচনা করলে শেখাটা দীর্ঘস্থায়ী হবে। এই অনলাইন প্লাটফর্মকে ফ্লেক্স বলা হয়।
ব্লেন্ডেড লার্নিং মেথডের চার ধরণের মডেল সবচেয়ে জনপ্রিয়। রোটেশন মডেল, ফ্লেক্স মডেল, এ লা কার্টে বা সেল্ফ ব্লেন্ড মডেল ও এনরিচড ভার্চুয়াল মডেল। তবে অনেকে রোটেশন মডেলের সাব-মডেলকে ভেঙে ছোট ছোট ছয়টি আবার বারটি মডেলের কথাও বলেছেন। তবে এই চারটি-ই মূলত বেসিক।
১. রোটেশন মডেল- এই মডেলে স্টুডেন্টরা ক্লাস ও ল্যাবে ঘুরে ঘুরে ক্লাস করে। তাহলে অনেকে প্রশ্ন করতে পারে, এক্ষেত্রে গতানুগতিক কম্পিউটার ল্যাবে ক্লাস করার পার্থক্য কী? মজার ব্যাপার হলো, দু’টো বিষয় সম্পূর্ণ আলাদা। একজন শিক্ষার্থী কোন লেসনে কতটুকু সময় দিচ্ছে, কতটুকু শিখতে পারছে, সেই সব ডাটা অ্যানালাইসিস করে ল্যাব থেকে ক্লাসরুমে টিচারকে নির্দেশনা দেওয়া হয়। একজন শিক্ষার্থী যদি দুই ঘন্টা ধরে কোন একটি বই নিয়ে থাকে তাহলে সে আসলে কতটুকু শিখলো, ট্র্যাডিশনাল পদ্ধতিতে সেটা সূক্ষ্ণভাবে মূল্যায়ন করা সম্ভব নয়। কিন্তু এক্ষেত্রে এ ধরণের কোন সীমাবদ্ধতা নেই। কোন একটা কোর্স কমপ্লিট করার ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের সময় বেঁধে দেওয়া হয় এবং কোর্সের যে কোন অনলাইন লার্নিং ব্যবহার করা বাধ্যতামূলক করে দেওয়া হয়। এই মডেলেও গ্রুপ প্রজেক্ট, অ্যাসাইনমেন্ট করতে হয়। প্রত্যেক স্টুডেন্টকে আলাদাভাবে মনিটরিং করা হয়। এই মডেলের চারটি সাব-মডেল হলো- স্টেশন রোটেশন, ল্যাব রোটেশন, ফ্লিপড রোটেশন, ইনডিভিজুয়াল রোটেশন।
২. ফ্লেক্স মডেল – ক্লাসকে ছোট ছোট গ্রুপে ভাগ করা হয়। একেকটি স্টেশনে তারা বিশ মিনিট সময় কাটায়, এরপর অন্য স্টেশনে ঘুরে ঘুরে ক্লাস করে। স্টেশনগুলো কিছুটা এরকম-
প্রথম স্টেশন- টিচার (ফেস টু ফেস টিচিং),
দ্বিতীয় স্টেশন- ইনডিভিজুয়ালি কম্পিউটার ওয়ার্ক,
তৃতীয় স্টেশন- গ্রুপ কম্পিউটার ওয়ার্ক,
চতুর্থ স্টেশন- গাইডেড প্র্যাকটিস।
৩. এ লা কার্টে – এই মডেলের ক্লাসরুম স্টুডেন্টরা বেশিরভাগ সময় কম্পিউটার লার্নিং- এ ব্যস্ত থাকে। কখনো কখনো টিচার ইন্সট্রাকশন দেয়, একসাথে দল বেঁধে সেমিনারে নিয়ে যায়।
৪. এনরিচড ভার্চুয়াল মডেল- একটি কোর্স বা বিষয় যেখানে শিক্ষার্থীদের তাদের রেকর্ডের শিক্ষকের সাথে সামনাসামনি শেখার সেশনের প্রয়োজন হয় এবং তারপরে তাদের বাকি পাঠ্যক্রমটি সামনা-সামনি শিক্ষকের কাছ থেকে সম্পূর্ণ করতে পারেন।